৮০% প্রবাসী কর্মীই কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে চান

প্রবাসী কর্মী
প্রবাসী কর্মী

সম্প্রতি আইএলও বাংলাদেশের করা এক জরিপ অনুযায়ী, এখনও ৮০% প্রবাসী কর্মীই কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে চান, কিন্তু আটকা পড়ে আছেন মহামারিতে। তাদের অধিকাংশেরই জমানো টাকা শেষ। দৈনন্দিনের খরচ মেটাতে গিয়ে ধার-দেনাও করতে হয়েছে তাদের।

মালয়েশিয়ায় কাজের পারমিট আছে শাহিন আলমের, আর তার মালিকও বলছে কাজে ফিরতে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে এখনও মালয়েশিয়ায় বাইরে থেকে মানুষ প্রবেশে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে ১৬ জানুয়ারি কাজের পারমিটের মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। শাহিন আলম এখন দুশ্চিন্তায় আছেন তার ভবষ্যত নিয়ে।

মালয়েশিয়ায় সাড়ে ৬ বছর কাজ করার পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরেন তিনি। যশোর থেকে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, ‘চার মাসের ছুটিতে দেশে এসেছি আমি। এখন এখানে আটকা পড়ে গেছি। আগে যদি জানতাম এমন হবে তাহলে কখনোই দেশে ফেরার কথা ভাবতাম না আমি।’

শাহিনের মতো আরও হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়েছেন দেশে। মহামারির কারণে কাজে ফিরতে পারবেন কি না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

যে টাকা জমিয়েছিলেন তা দিয়ে একটা মোটর রিকশা কিনে জীবিকা উপার্জন করছেন শাহিন।

সম্প্রতি আইএলও বাংলাদেশের করা এক জরিপ অনুযায়ী, এখনও ৮০% প্রবাসী কর্মীই কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে চান, কিন্তু আটকা পড়ে আছেন মহামারিতে।

তাদের অধিকাংশেরই জমানো টাকা শেষ। দৈনন্দিনের খরচ মেটাতে গিয়ে ধার-দেনাও করতে হয়েছে তাদের।

আইএলও বাংলাদেশের ‘রিটার্নি মাইগ্র্যান্টস প্রোফাইল অ্যান্ড নিডস অ্যাসেসমেন্ট’ নামের এই জরিপটি অর্থায়ন করেছে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি)। প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণের জন্য মহামারি পরবর্তী পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করার লক্ষয়েই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।

গবেষণাটির জন্য দেশের ৪ জেলা- কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও যশোরের ৬১৬ জন বিদেশফেরত প্রবাসী কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে সংস্থাটি। ২০২০ সালের জানুয়ারির পর থেকে এনারা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। একটা ন্যুনতম সংখ্যার নারী অংশগ্রহণকারীদের নিশ্চিত করতে আরও কয়েকটি জেলায় জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

অংশগ্রহণকারীদের ৮৫% এর পরিবারই প্রবাসে অর্জিত টাকার উপর নির্ভরশীল এবং যত দ্রুত সম্ভব তাদের ফিরে যাওয়া দরকার। প্রতি ৫ জনে মাত্র একজনের ৫০ হাজার টাকার মতো জমানো আছে। বাকিদের অর্ধেকেরও বেশি জানাচ্ছেন, দেশে ফেরার পর থেকে ১ লাখেরও বেশি টাকা ঋণ নিয়েছেন তারা।

৩ বছর আগে ৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ওমান গেছিলেন মোহাম্মদ সবুজ। দুই বছরে অর্ধেকের মতো টাকা শোধ করতে পারলেও মহামারির কারণে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। এখন সেই টাকা শোধ দেওয়া তো দূরে থাক, নিজের ৬ সদস্যরে পরিবারের ভরণপোষনের জন্য স্থানীয় এনজিও’র কাছ থেকে আবারও ঋণ করতে হয়েছে তাকে।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সবুজ জানান, “আমার মালিক চায় আমি ফিরে যাই, কিন্তু এদিকে আমার ভিসার মেয়াদ বাতিল হয়ে গেছে। এখন কি যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছি, বলে বুঝাইতে পারব না।’

যদি ভিসা আর কাজের পারমিট নবায়নও হয়, তবু বিমানের টিকিট কিনতেও ঋণ করতে হবে তাকে।

প্রবাসে কর্মীদের অভিজ্ঞতা

প্রবাসে থাকা অবস্থায় কর্মীদের ১৭% জানিয়েছেন যে তারা অনাহারের মধ্যে দিয়ে গেছেন। ৩৯%ই পর্যাপ্ত আবাসনের সুযোগ পাননি, ৭% অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন তারা শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে গেছেন, ৬৬% দেশে ফিররেছেন একেবারে খালি হাতে।

তাদের ৮৫%ই জানাচ্ছেন, সেখানে থাকতে বা দেশে ফিরতে তাদের ঋণের প্রয়োজন। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের শ্রমিকরা অনেক কম মজুরি পান। আর মহামারিতে তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন কিংবা বেতন কমে গেছে।’

প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দের পরিমাণও কম। মাত্র ৪% পরিবার এর আওতায় সহযোগিতা পেয়েছেন।

দেশে ফেরার পরিস্থিতি

৬৫% পুরুষকর্মী দেশে ফিরেছেন খালি হাতে। আর নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা আরও বেশি, প্রায় ৯৩%।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই ফিরেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। আর বাকিরা মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কাজ করতেন। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে ফেরা শ্রমিকরা তাদের কর্মস্থলে ফিরে যেতে চান। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরা শ্রমিকদের মধ্যে এই প্রবণতা কম। এর কারণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে কাজের অনিশ্চয়তার পরিমাণ বেশি বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ছিলেন নারী শ্রমিক। তাদের অভিজ্ঞতা আরও ভয়ানক।

যশোরের আয়রা খাতুন আর তার মেয়ে সৌদি আরবে কাজ করতেন। গত এপ্রিলে সৌদি আরব থেকে ফেরা এক হজ্ব ফ্লাইটে করে তাদের দেশে পাঠানো হয়।

যশোর থেকে ফোনে আয়রা জানান, ‘আমাকে আমার মালিক মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েচ্ছিল।’ পরে তার মেয়ের কর্মক্ষেত্রের মালিক আয়রাকে উদ্ধার করে এবং হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।

এই অভিজ্ঞতা থেকে রিতিমতো মস্তিষ্ক বিকারগ্রস্ত হয়ে গেছেন আয়রা। ফোনে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলেন না। তার স্বামী বাবর কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, শুধু তাই নয়, আয়রার পাসপোর্ট, মোবাইলের সিম কার্ড পর্যন্ত রেখে দিয়েছিল তার মালিক। এমনকি সে অসুস্থ হয়ে গেলে এবং শারীরিক নির্যাতনের পর চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেনি।

আয়রার মেয়ে শারমিনের মালিক ভালো, সে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু বাবর চায় না তার স্ত্রী-কন্যা বিদেশে কাজ করতে যাক। সে নিজেই কিছু করতে চায়। বাবর জানান, ‘আমি ভাবছি গবাদি পশুর পালব। কিন্তু এই ব্যবসা শুরু করার মতো কোন টাকা আমার কাছে নাই।’

সর্বশেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৪৫
Desk
এড্যমিন

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও